
একক শলাকা বাংলাদেশে বিভিন্ন সমস্যায় ইন্ধন দিচ্ছে
বাংলাদেশে একক শলাকার বিক্রি বৈষম্য, তামাকজনিত রোগ এবং তরুণ ভোক্তাদের মধ্যে উচ্চ হারের ধূমপানে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
একটি (খুবই) ভাল সংবাদ দিয়ে শুরু করি। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের সার্বিক হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ১৫ বছর বা তদুর্ধ বয়সীদের মধ্যে তামাক ব্যবহার প্রায় ৪৩% থেকে প্রায় ৩৫% এ নেমে এসেছে।
এমন একটি পৃথিবী যেখানে তামাক ব্যবহার ও তামাক বর্জনের হারে ধনী ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত, সেখানে তামাক ব্যবহারের এ হ্রাস অসাধারণ: বাংলাদেশে ধূমপান-প্রবণতা নিয়ে একাধিক গবেষণার সার সংক্ষেপ নিয়ে করা টোব্যাকো ইকোনোমিক্স-এর প্রতিবেদন অনুসারে, এটা সমাজের সব আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে ঘটেছে।
এ অগ্রগতি দৈবক্রমে ঘটেনি। বরং একটি বৈশ্বিক চুক্তির অধীন অঙ্গীকারের আলোকে বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রমাণিত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে। যদিও কয়েকটি পাবলিক প্লেসে এখনও ধূমপান এলাকা রয়ে গেছে, তবে অধিকাংশ পাবলিক প্লেসের অভ্যন্তর এখন ধূমপানমুক্ত। দেশটি তামাকের বিজ্ঞাপন ও প্রণোদনা নিষিদ্ধকে ব্যাপকতর করেছে এবং পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ৫০% স্থানজুড়ে ছবিযুক্ত স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর নির্দেশনা জারি করেছে। এসব পদক্ষেপ ও অন্যান্য পদক্ষেপসমূহ তামাক ব্যবহার কমাতে ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু সমস্যা হতে সমাধান অনেক দূরে। বাংলাদেশ এখনও বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তামাক ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে অন্যতম। আনুমানিক এক কোটি নব্বই লক্ষাধিক মানুষ ধূমপান করে (ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের বিপরীতে) এবং এর মধ্যে, প্রায় এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষা মানুষ ধূমপান করে। এবং, এ জরিপ সম্পন্ন করার পাঁচ বছরের মধ্যে দেখা যায়, ২৮% তামাক ব্যবহারকারী তাদের তামাক ব্যবহারের হার বৃদ্ধি করেছে।
বাংলাদেশে সিগারেটের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ, অর্থবহ ও দীর্ঘমেয়াদে কমিয়ে আনার পথে কী বাধা? আপাতদৃষ্টিতে, প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে নগন্যভাবে দেখা হয়: একক শলাকা।

বাংলাদেশে একক শলাকার বিক্রি
বাংলাদেশ ও সমগ্র পৃথিবীতে একটি ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে একক শলাকা বা পৃথকভাবে সিগারেট বিক্রি হওয়া এবং যা প্যাকেটের অংশ হিসাবে বিক্রি হয় না। একটি পুরো প্যাকেটের চাইতে একটি একক শলাকা ক্রয় করা অনেক সস্তা, যা শিশু, তরুণ ও স্বল্প আয়ের মানুষহ যারা মূল্য সংবেদনশীল তাদের কাছে সিগারেটকে সহজলভ্য করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের যে কোন স্থানে এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ৮০ – ২৮৪ টাকা (০.৭৫ হতে ২.৬৫ ইউএস ডলার), যেখানে একটি একক শলাকা মাত্র ৫টাকা (০.৫ ইউএস ডলার)। এ সহজলভ্যতা তরুণদের ধূমপান শুরু করাকে সহজ করে তোলে এবং অন্যদেরকে ধূমপান ছাড়তে বা কমাতে নিরুৎসাহিত করে।
তামাকের নেশা ধরে রাখতে ভূমিকা রয়েছে বিধায় পৃথিবীর কমপক্ষে ৮০টি দেশে সিগারেটের একক শলাকার বিক্রি নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ, যদিও বাংলাদেশে এটা এখনও বৈধ। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের সর্বত্র একক শলাকার বিক্রি হয়। ২০১৮ সালে গবেষক ড. আরিফা হাসনাত আলী পরিচালিত “সিগারেটের খুচরা ব্যবসা এবং তামাক নিয়ন্ত্রণে ক্ষতি: বাংলাদেশের শহর এলাকার বর্তমান চিত্র” শীর্ষক একটি গবেষণায় সিগারেট বিক্রেতাদের স্বাক্ষাতকার নেয়া হয়। এতে দেখা যায়, ৯৯% বিক্রেতা একক শলাকা বিক্রি করে। বিক্রেতারা আরও জানায় যে, অধিকাংশ দিনেই সিগারেটের প্যাকেট বিক্রির চাইতে একক শলাকার বিক্রি তিনগুণ বেশি এবং একক শলাকার ভোক্তাদের অধিকাংশই তরুণ।
২০২১ সালে মো. আল-আমিন পারভেজ এর “সিগারেটের একক শলাকা ও প্যাকেটব্যতিত ধোঁয়াবিহীন তামাক বিক্রি নিষিদ্ধ বিষয়ে বাংলাদেশে বিকল্প নীতির অনুসন্ধান” শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, গবেষকেরা দেশের ৩০০০ প্রাপ্তবয়সী তামাক ব্যবহারকারী উপর জরিপ করেছে। এতে দেখা যায়, ধূমপায়ীদের ৫৭% একক শলাকা ক্রয় করে। গবেষকেরা দেখতে পান যে, তরুণদের নিকট একক শলাকা জনপ্রিয়। ৪০ বছর ও তদুর্ধদের চাইতে ১৮ – ২৪ বছর বয়সীদের কাছে একক শলাকা ক্রয় প্রায় আড়াই গুণ বেশি। একক শলাকা দরিদ্রদের মধ্যেও জনপ্রিয়। যাদের মাসিক উপার্জন ৫০০০ টাকার কম (৪৬ ইউএস ডলার) তারা ২৫,০০০ টাকার (২৩৩ ইউএস ডলার) বেশি উপার্জনকারীদের চাইতে একক শলাকা ৪গুণ বেশি ক্রয় করে।
বাংলাদেশে একক শলাকা বিক্রির সামাজিক ক্ষতি
এসব ফলাফলে প্রতীয়মান হয় যে, তামাক কোম্পানির আরেকটি উপায় হ’ল একক শলাকা যা ব্যাপক ও পদ্ধতিগত বৈষম্য সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। তামাকের বাজার এমন মানুষকে লক্ষ্য করে যাদের তামাক ব্যবহারের আর্থিক চাপ সহ্য করতে পারে এবং তামাকজনিত রোগের ব্যয় বহনের সামর্থ কম।

একক শলাকার কারণে ধূমপায়ীরা বাংলাদেশের সিগারেটের প্যাকেটের বিদ্যমান সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা দেখতে পায় না।
এছাড়া, একক শলাকার কারণে ধূমপায়ীরা বাংলাদেশের সিগারেটের প্যাকেটের বিদ্যমান সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা দেখতে পায় না । এ তথ্য ঘাটতি ধনীদের তুলনায় দরিদ্রদের স্বাস্থ্যকর পছন্দকে প্রভাবিত করে এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়িয়ে তোলে।
এছাড়া একক শলাকা আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করে এবং দরিদ্র ধূমপায়ীকে আরও দরিদ্র করে। যদিও পুরো প্যাকেটের চাইতে একটি শলাকা সস্তায় ক্রয় করা যায় কিন্তু প্রতিটি সিগারেটের দাম হিসাবে পুরো প্যাকেটের চাইতে চাইতে একক শলাকার প্রকৃত ব্যয় বেশি। অর্থাৎ, যাদের অর্থ কম তারা প্রতিটি সিগারেটের জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করে।
তামাক ব্যবহারে পারিবারিক বাজেট কমিয়ে দেয়। গড়ে, বাংলাদেশের ধূমপায়ীরা সিগারেটের জন্য প্রতি সপ্তাহে ৫৩৭ টাকা (৫ ইউএস ডলার) খরচ করে, যা সীমিত বাজেটের উপর চাপ তৈরি করে। একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহার করে না এমন পরিবারের চাইতে তামাক ব্যবহারকারী পরিবার প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন পোশাক, বাসস্থান, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও যাতায়াতে কম অর্থ ব্যয় করে। যখন অসুস্থতা দেখা দেয়, তখন এ পরিবারগুলো আরও বেশি আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হয়। একটি গবেষণায় দেখা যায়, দরিদ্ররা গড়ে ১৭,৩৭১ টাকা (১৬২ ইউএস ডলার) ব্যয় করে যখন তারা তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়।
তামাক ব্যবহার কমাতে এবং বৈষম্য দূর করতে একক শলাকা নিষিদ্ধ করা জরুরি
ধূমপান ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজের জন্য একটি সমস্যা। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ১৬০ হাজারের বেশি তামাক ব্যবহারকারী মারা যায়। গবেষকেরা তুলে ধরেন যে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যয়ের পরিমাণ ৩০৫ বিলিয়ন (২.৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার) বা জিডিপি’র ১.৪%।
২০১৮ সালে যারা তামাক ব্যবহার বৃদ্ধি করে তাদের ১৮.৫% তামাকজাত দ্রব্যের ক্রয়ক্ষমতাকে একটি কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন। সিগারেট ক্রয়ের ক্ষেত্রে একক শলাকা হচ্ছে সবচাইতে সাশ্রয়ী। যতদিন একক শলাকা সস্তা ও সহজলভ্য থাকতে ততদিন ধূমপানের হার কার্যকরভাবে কমানো কঠিন হবে, বিশেষ করে তরুণ ও দরিদ্রদের মধ্যে যারা ইতোমধ্যে বৈষম্যের মুখোমুখি। একক শলাকা বিক্রি অবশ্যই নিষিদ্ধ করা উচিত এবং এটি বাস্তবায়নও করতে হবে।
* এপ্রিল ২০২৩ সময়ে বাংলাদেশ টাকার বিপরীতে ইউএস ডলার