কয়েক দশকের মিথ্যাচার প্রমাণ করে তামাক কোম্পানিগুলোর কথা বিশ্বাস করা যায় না
তামাক কোম্পানির মিথ্যাচার বিস্তৃত কয়েক দশক ও প্রজন্মজুড়ে—তামাকের ক্যান্সারের সাথে সম্পর্ক থেকে শুরু করে নিকোটিনের আসক্তিকর প্রকৃতি পর্যন্ত প্রত্যেকটি বিষয় যেখানে অস্বীকার করা হয়েছে।
দশকের পর দশক, বড় তামাক কোম্পানিগুলো যেগুলো নিজেরাও সত্য বলে জানে তা জনসমক্ষে অস্বীকার করে গেছে । তারা ছলচাতুরিপূর্ণ প্রচারাভিযান,চালিয়েছে,শপথে নেওয়া অবস্থাতেও নীতিনির্ধারকদের বোকা বানিয়েছে এবং পক্ষপাতমূলক গবেষণায় টাকা ঢেলেছে যাতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। সত্য ধামাচাপা দেয়ার দিন যত গড়িয়েছে, ততও বেশি মানুষ ধূমপানে জড়িয়েছে এটি তাদের শরীরের কীরূপ ক্ষতিসাধন করছে তা না জেনেই। যেসব নিয়মনীতি মানুষকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে পারত এবং তাদেরকে তামাক কোম্পানির লোভনীয় ফাঁদ থেকে রক্ষা করতে পারত, সেগুলোর বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা হয়েছে।
এখন, কোম্পানিগুলো তাদের নতুনতর পণ্যগুলির নিরাপত্তা ও “ঝুকি-হ্রাসকারী” প্রকৃতি নিয়ে ক্রমাগত সম্ভাব্য বিপজ্জনক দাবি করে যাচ্ছে, যেমন উত্তপ্ত তামাক পণ্যাদি। কিন্তু আমরা কি তামাক প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি প্রশ্নাতীতভাবে বিশ্বাস করতে পারি? কোম্পানির প্রতারণা ও স্বাস্থ্যের আগে মুনাফাকে প্রাধাণ্য দেয়ার যে অতীত ইতিহাস তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আমরা তা করতে পারি না।
তামাক কোম্পানির বলা মূল কিছু অসত্য নিয়ে দশক-প্রতি আলোচনা করা হয়েছে এখানে, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে,যা কোম্পানি জানে এবং যা তারা বলে তার মধ্যে সবসময় মিল থাকে না।
১৯৫৩: “ধূমপান অন্যতম কারণ [ফুসফুসের ক্যান্সারের] এমন কোনো প্রমাণ নেই”
১৯৫০ এর দশকে,যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্টে পরিচালিত বিষদ গবেষণা ধূমপানকে ফুসফুস ক্যান্সারের অন্যতম সম্ভাব্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক। সেবার প্রথম বারের মতন উত্থাপিত না হলেও তা জনমনে দুশ্চিন্তার জন্ম নেয়।
এমনকি তামাক কোম্পানির পক্ষে কাজ করা গবেষকদেরও এই সংযোগ সম্পর্কে আগ্রহী হতে দেখা যায়। ১৯৫৩ সালে আর জে রেনল্ডস’র একটি গোপনীয় প্রতিবেদনে একজন গবেষক উল্লেখ করেছিলেন যে সিগারেট ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে এমন তত্ত্বকে রোগীভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত সমর্থন করে।
তামাক কোম্পানিগুলোকে তাদের বিদ্যমান ও সম্ভাব্য ক্রেতাদের আশ্বস্ত করে প্রতিক্রিয়া জানাতে হত।১৯৫৪ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের তামাক কোম্পানিগুলো “ধূমপায়ী দের জন্য অকপটে কিছু কথা” প্রকাশ করল। বিবৃতিটিতে তামাক কোম্পানিগুলো ক্যান্সারের সাথে সম্পর্ককে অস্বীকার করল,বিবৃত করে “ আমরা বিশ্বাস করি আমরা যেসব পণ্য তৈরি করি তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়।“ তারা ফুসফুসের ক্যান্সার সংক্রান্ত স্বাধীন গবেষণাকে প্রশ্নবিদ্ধ্ব করার তালে ছিল,এই বলে যে “ এমন কোনো প্রমাণ নেই যে সিগারেট সেবন অন্যতম কারণ”। যদিও গবেষণা অনুযায়ী তামাক কোম্পানিগুলো ১৯৫০ এর মাঝামাঝিতে জেনে গিয়েছিল যে তাদের পণ্যাদি ক্যান্সারের সাথে সম্পর্কিত এবং আসক্তিকর।
১৯৬৪: “তামাক ক্ষতিকর উপাদান আছে এমন ধারণা আমরা গ্রহণ করি না”
১৯৬০’র শুরুর দিকে, দুইটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে ফুসফুস ক্যান্সারের একটি প্রমাণিত কারণ হল ধূমপান। ১৯৬২ সালের রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিশিয়ান্স এবং ১৯৬৪ সালের যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন প্রধানের প্রতিবেদনে জনসমক্ষে উপসংহার টানা হয় যে সিগারেট সেবন ফুসফুস ক্যান্সারের একটি কারণ এবং এটাও যে ধূমপান অন্যান্য ঝুঁকির কারণগুলোর তুলনায় “অনেক বেশি ক্ষতিকর”।
এরপরও তামাক কোম্পানিগুলো সিগারেটের ক্ষতিগুলো জনসমক্ষে অস্বীকার করতে থাকে। ১৯৬৪ সালে ফিলিপ মরিসের অবস্থান ছিলঃ “আমরা এই ধারণার সাথে সহমত পোষণ করি না যে তামাকে ক্ষতিকর উপাদান আছে।”
ধূমপান কমিয়ে আনা বা ছেড়ে দেয়া থেকে লোকজনকে নিবৃত্ত করতে গিয়ে তামাক কোম্পানি অতীতে যে রণকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে এবং এখনও ব্যবহার করছে তা হলঃ জনস্বাস্থ্য গবেষণা নিয়ে চারপাশে সন্দেহ ও বিভ্রান্তি তৈরি করা। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর নিয়ন্ত্রণাধীন একটি প্রতিষ্ঠান ১৯৬৯ সালের অভ্যন্তরীণ একটি স্মারকে সরল ভাষায় জানায়ঃ “ সন্দেহই আমাদের পণ্য কেননা জনমনে থাকা জ্ঞানভাণ্ডারের সাথে প্রতিদ্বন্দিতার ক্ষেত্রে এটাই সর্বোত্তম উপায়। এটি বিতর্ক সৃষ্টি করারও একটি মাধ্যম।
বৃহত্তম সাতটি তামাক কোম্পানির প্রধাণ নির্বাহীগণ যুক্তরাষ্টের আইনসভায় শপথ গ্রহণপূর্বক সাক্ষ্য প্রদান করেন যে নিকোটিনকে আসক্তিকর বলে বিশ্বাস করেন না তারা।
১৯৭৬ঃ “বার বছরের প্রচেষ্টার সমাপ্তি ঘটল স্বল্প টারের ধোঁয়ার অভূতপুর্ব স্বাদে”
জনসমক্ষে ধূমপানের স্বাস্থ্যগত ক্ষতির কথা অস্বীকার করা অব্যাহত রাখলেও, তামাক কোম্পানিগুলো যুগপতভাবে “হালকা” ও “কোমল” সিগারেটের প্রচারণা চালানো শুরু করল।৫০ এর দশকে কোম্পানিগুলোর বাজারে আনা বাটওয়ালা সিগারেটের পাশাপাশি এই পণ্যাদি বেশি নিরাপদ এমন ধারণা দিতে লাগল এবং “স্বাস্থ্যের ঝুঁকি হ্রাসের অন্তর্নিহিত অঙ্গীকার” এর বার্তা সহকারে বিপণন চালানো হল।উদাহরণস্বরূপ ১৯৭৬ সালের ফিলিপ মরিসের এই বিজ্ঞাপনটি সদম্ভে শিরোনাম দেয়, “বার বছরের প্রচেষ্টার সমাপ্তি ঘটল স্বল্প টারের ধোঁয়ার অভূতপুর্ব স্বাদে”। এই বিজ্ঞাপনটি সিগারেটটির “বর্ধিত স্বাদ” এর প্রচারণার পাশাপাশি দাবি করে যে “আজকের দিনে ধূমপানে প্রাপ্ত সর্বনিম্ন টার” দেয়া হয় এতে।
১৯৭৭ সালের বিএটির একটি নথি কোম্পানিগুলোর উদ্দ্যেশ্য উন্মোচিত করেঃ “এই ক্ষেত্রের সকল কাজ ক্রেতাকে সিগারেট ও ধূমপানের অভ্যাস বিষয়ে আস্বস্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হওয়া উচিত। এটা বিভিন্নভাবে করা যেতে পারে যেমন- স্বল্প মাত্রা প্রদানের দাবি…এবং “কোমলতার” ধারণা দিয়ে।
তথ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায়,সিগারেট কোম্পানিগুলো অবগত ছিল যে এসব পরিবর্তিত পণ্যাদির আদতে কোনো স্বাস্থ্যগত উপকার নেই।এমনটা হতে লাগল যে ধূমপায়ীরা প্রায়শই আরও গভীরভাবে এবং অধিক হারে ধোঁয়া সেবন করছে। ১৯৭৯ সালে বিএটির একজন বিজ্ঞানী বলেন যে, “স্বল্প টার সিগারেট বেছে নেয়ার প্রভাব হিসেবে ধূমপানের ঝুঁকি না কমে বেড়ে যেতে পারে।“
১৯৮৭ঃ “আমি জানি আমার ধূমপান আপনার ক্ষতি করে এমন প্রমাণ নেই কোনো”
১৯৮০ এর দশকে,তামাক কোম্পানিগুলোর বিষয়ে একটা নতুন আশঙ্কা নজরে এলঃ পরোক্ষ ধূমপানের বিপদ সম্পর্কে জনমনে বাড়তি উদ্বেগ। এসব আশঙ্কা সত্য হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল যখন যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন প্রধান ১৯৮৬ সালে প্রকাশ করা এক প্রতিবেদনে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে পরোক্ষ ধূমপান রোগের কারণ।
এক বছর পর, ফিলিপ মরিস পরোক্ষ ধূমপান ক্ষতিকর এমন দাবি জনসমক্ষে প্রত্যাখান করল একটি বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে যেখানে বলা হল, “আমি জানি আমার ধূমপান আপনার ক্ষতি করে এমন প্রমাণ নেই কোনো।”
ধূমপান হ্রাস বা ছেড়ে দেয়ার আরও একটি কারণ থেকে ধূমপায়ীদের বিরত রাখতে, এবং জনসমাগমস্থলে ধূমপানে নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন নেই নীতিনির্ধারকদের এমনটা বোঝাতে কোম্পানিগুলো গবেষণার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে লাগল।১৯৮৮ সালে, লরিলার্ড,ফিলিপ মরিস এবং আর জে রেনল্ডস মিলে অভ্যন্তরীণ বাতাস সংক্রান্ত গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৯৮ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া কেন্দ্রটি যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচার বিভাগ পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব সম্পর্কে “যুক্তরাষ্ট্রের জনতাকে প্রতারণাপূর্বক বিভ্রান্ত করতে” প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে ঘোষণা দেয় অবশেষে।
১৯৯৪ঃ “নিকোটিন বা আমাদের পণ্যগুলো আসক্তিকর,আমি তা বিশ্বাস করিনা”
১৯৯৪ সালে, “বৃহত্তম সাতটি তামাক কোম্পানির প্রধাণ নির্বাহীগণ যুক্তরাষ্টের সংসদে শপথ নিয়ে সাক্ষ্য দেন যে, তারা মানেন না নিকোটিন আসক্তিকর।“যুক্তরাষ্ট্রের তামাক কোম্পানির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জোসেফ টাডিও আইনসভাকে বলেন: “আমি বিশ্বাস করি না যে নিকোটিন বা আমাদের পণ্য আসক্তিকর।” অন্য ছয়জন সিইওও তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
তারপরও, তামাক কোম্পানিগুলোর নিকোটিনের আসক্তিকর প্রকৃতির ব্যাপারে অন্তত ১৯৬০ এর দশক থেকেই ধারণা ছিল। তামাক কোম্পানিগুলোর বক্তব্য ছিল সুস্পষ্ট। বিএটির অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান ব্রাউন এবং উইলিয়ামসনের একজন নির্বাহী ১৯৬৩ সালে লেখেন “ নিকোটিন আসক্তিকর। আমরা,তাই,নিকোটিন নামক আসক্তিকর নেশাদ্রব্য বিক্রির ব্যবসা করি।“ বিএটির ১৯৬৭ সালের একটি নথিতে বিবৃত হয় ঃ “ধূমপান একটি আসক্তকারী অভ্যাস যার জন্য নিকোটিন দায়ী এবং ধূমপায়ীর সেবনের হার নিকোটিনের রূপভেদের ওপর নির্ভর করে ধূমপায়ীর সেবনের হার।“
আধুনিক তামাক কোম্পানিগুলোর মিথ্যাগুলোকে গভীরভাবে খতিয়ে দেখা
বিংশ শতাব্দীতেই শেষ হয়ে যায় নি তামাক কোম্পানিগুলোর সত্যকে আড়াল করা ও প্রতারণা। তখন থেকে, কোম্পানিগুলো পরিবেশের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়ার দাবি করলেও কার্বন নিঃসরণ,পানি দূষন, বর্জ্য ও অন্যান্য পরিবেশ দূষণে তাদের দায় বৃহৎ। তামাকশিল্পে শিশুশ্রম বন্ধ করা নিয়ে কাজ করার দাবি করলেও এর মূল কারণগুলো তারা অব্যাহতভাবে জারি রেখেছে।
সিগারেট কোম্পানিগুলো এমনকি তাদের বয়ানগুলো নতুন স্লোগান দিয়ে হালনাগাদ করছেঃ ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল একটি “ধোঁয়াবিহীন ভবিষ্যত” এর প্রচারণা চালাচ্ছে এবং বিএটি “একটি উন্নত ভবিষ্যত” এর অঙ্গীকার জানাচ্ছে।
কিন্তু জনসাধারণ ও নীতিনির্ধারকদের এটা ভুলে যাওয়া উচিত নয় কীভাবে তামাক কোম্পানিগুলো জেনেশুনে ক্যান্সারের সাথে সম্পর্ককে অস্বীকার করেছে, নতুন পণ্যাদির স্বাস্থ্যগত উপকারিতা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার চালিয়েছে, পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিসমূহের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, একটি প্রতিষ্ঠান বানিয়েছে এর স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ গবেষণা করাতে এবং প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে নিকোটিন আসক্তিকর নয় অন্যথা জেনেও।কয়েক দশকের প্রতারণাপূর্ণ আচরণ ও মিথ্যাচার প্রমাণ করে যে তামাক কোম্পানিগুলি জনস্বাস্থ্যের চেয়ে তাদের মুনাফার স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়।