আরও সংবাদ অনুসন্ধান করুন

ডিজিটাল বিপদঃ কিভাবে অনলাইনে তামাক কোম্পানির বিজ্ঞাপন তরুণদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে

তামাক কোম্পানির ডিজিটাল বিজ্ঞাপন ইন্টারনেটের সর্বব্যাপিতা এবং তরুণ সমাজের অনলাইনে সার্বক্ষণিক উপস্থিতির ফায়দা নেয়।

গণমাধ্যমে ক্রমাগত দেশগুলো তামাক বিজ্ঞাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে তামাক কোম্পানিগুলো নতুন পন্থায় ও আরও সঙ্গোপনে তরুণ যুবাসহ সম্ভাব্য ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। এই কোম্পানিগুলো ডিজিটাল মাধ্যমের শরণাপন্ন হচ্ছে।

Online tobacco advertising is reaching young people every day

ডিজিটাল তামাক কোম্পানির বিজ্ঞাপন

ডিজিটাল মাধ্যমে যে বিজ্ঞাপন পরিবেশিত হয় তাই ডিজিটাল মার্কেটিং। এটা ঘটে যখন কোন অ্যাপে গেইম খেলার সময় হঠাত চোখের সামনে বিজ্ঞাপন চলে আসে। বা আপনার ইন্সটাগ্রাম ফিডে কোন ইনফ্লুয়েন্সার যখন কোন পণ্য প্রচারণা চালায়। এটি আপাতদৃষ্টিতে গুগলের অর্গানিক সার্চ ফলাফল। এটা পারস্পরিক,এটা ব্যক্তিগতকৃত, এটা শেয়ারযোগ্য এবং এটা সর্বব্যাপী। এর কারণে স্থির, এনালগ বিপণন যেমন প্রিন্ট বিজ্ঞাপন বা টিভি বা রেডিওতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের তুলনায় এটি অধিক প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা রাখে।

তামাক কোম্পানিগুলো সিগারেট,ই-সিগারেট, উত্তপ্ত তামাক সামগ্রী এবং নিকোটিন থলিসহ তাদের বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে। এর অন্যতম কারণ? এখানে তাদের উদ্দিষ্ট বাজার অর্থাৎ তরুণ সমাজের উপস্থিতি রয়েছে।

তামাক কোম্পানিগুলো অবগত আছে যে নেশাজাতীয় দ্রব্যাদির মাধ্যমে তরুণ সমাজকে লক্ষ্যবস্তু করলে আজীবন এর সেবনকারী হিসেবে তাদের পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর বিদ্যমান নীতিমালা যদিও গণমাধ্যমে তামাক বিজ্ঞাপন, পণ্য প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতার মাত্রা কমাতে কাজে দিচ্ছে, ডিজিটাল মার্কেটিং একটি নতুন ক্ষেত্র এবং এ বিষয়ক উপযুক্ত নীতিমালা অদ্যবধি তৈরি হয়নি। নবায়নকৃত নীতিমালার অভাবে অগণিত তরুণ যুবার কাছে তামাক কোম্পানির বিপণন পৌঁছে যাচ্ছে।

ডিজিটাল মাধ্যমে তামাক কোম্পানির বিজ্ঞাপন যেমন

যেসব কৌশল অবলম্বন করে তামাক কোম্পানিগুলো বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষকে সিগারেটে আসক্ত করে ফেলেছে, অনলাইনেও সেসব অবলম্বন করা হচ্ছে নব্য পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে, যার মধ্যে রয়েছে নিকোটিন থলি, ই-সিগারেট এবং উত্তপ্ত তামাক সামগ্রী। ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে প্রায়শই দেখানো হয় এসব পণ্য কেতাদুরস্ত, প্রতিদিনের জীবনযাপনে ব্যবহার্য এবং তরুণ,আকর্ষণীয়, স্বাস্থ্যবান মানুষ এসব ব্যবহার করেন।

এসব ডিজিটাল মার্কেটিং এর অনেকটাই সহজে বোধগম্য।

২০২০ সালে, স্ট্যানফোর্ডের গবেষকগণ ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনালের উত্তপ্ত তামাক সামগ্রী আইকিউওএস এর ইন্সটাগ্রাম, ফেসবুক, টিকটকে এবং ইনফ্লুয়েন্সার, পণ্যদূত দ্বারা, এবং জাপানে অফিসিয়াল লাইন মেসেঞ্জার এপের মাধ্যমে সম্পাদিত ডিজিটাল মার্কেটিং এর ওপর একটি সুবিন্যস্ত তালিকাযুক্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পিএমআইয়ের অফিসিয়াল আইওকিউএস একাউন্টের কনটেন্টসমূহ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে আইকিউওএস স্থান পেয়েছে কফি, অ্যালকোহল এবং খাবারের পাশাপাশি বা ক্রীড়া ও বহিরঙ্গণ কার্যক্রমের আশেপাশে, যা আসক্তকারী তামাক পণ্যকে উপস্থাপন করছে স্বাস্থ্যকর, দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্যের মত করে। ২০১৯ সালে রয়টার্সের একটি উন্মোচনকারী প্রতিবেদনে উঠে আসে মাত্র ২১ বছর বয়স এমন কমবয়সী তরুণ ইনফ্লুয়েন্সার দের সাথে আইকিউওএস প্রচারণায় কাজ করে কোম্পানিটি তাদের নিজেদের বিপণন নীতিমালা ভঙ্গ করে, যার ফলে পিএমআইকে একটি বৈশ্বিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিপণন ক্যাম্পেইন বাতিল করতে হয়।

অনলাইনে তামাক বিপণন অনুসরণ ও বিশ্লেষণ করা ডিজিটাল মাধ্যম নজরদারি ব্যবস্থা টার্মের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইন্দোনেশিয়ার তরুণরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ই-সিগারেট বিপণনের সম্মুখীন হয়। এই গবেষণা অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ার ১৩-১৫ বছর কিশোরদের অন্তত অর্ধেক অনলাইনে তামাক বিপণন প্রত্যক্ষ করেছে। প্রতিবেদনের জন্য বিশ্লেষণ করা ৮ শতাংশ পোস্টে ই-সিগারেটকে জৌলুসপূর্ন হিসেবে দেখানো হয়েছে। ৬০ শতাংশ পোস্টে পণ্যগুলো দেখানো হয়েছে আবশ্যকীয়, উচ্চ-প্রযুক্তির গ্যাজেট হিসেবে এবং ১৩ শতাংশ পোস্টে পার্টি/বিনোদনের অনুষঙ্গ হিসেবে।

শুধু বৃহৎ তামাক কোম্পানিগুলোই যে ডিজিটাল মার্কেটিং এর ফায়দা নিচ্ছে তা নয়। টার্ম এর আরেক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিড়ি কোম্পানিও ফেসবুকে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। এ ধরণের প্রচারণা তরুণ সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণঃ ৪৭ শতাংশ ব্যবহারকারী তাদের দশম জন্মদিনের পূর্বেই তাদের প্রথম বিড়ি সেবন করেছে।

কোম্পানিগুলোর বিপণন কৌশলে ক্রমাগত পরিবর্তন আসছে। ২০২২ সালে ট্রুথ ইনিশিয়েটিভের গবেষণাতে উঠে এসেছে ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে উত্তপ্ত তামাক সামগ্রী যেমন পিএমআইয়ের আইকিউওএস, জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনালের প্লুম এবং ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর গ্লো এর প্রচারণা সংক্রান্ত টুইটার পোস্টের সংখ্যা দ্বিগুন হয়েছে, তবে মূলত বাণিজ্যিক টুইটের (বাণিজ্যিক ওয়েবসাইট বা ব্র্যান্ড প্রচারণা বার্তা থেকে আসা বা সম্পর্কিত) বদলে অর্গানিক পোস্ট (ক্রয়কৃত নয়) হিসেবে আসা শুরু হয়েছে এগুলো। এসব অর্গানিক টুইট ভাইরাল বিপণনে রূপ নেয় এবং কোম্পানিগুলোকে বাণিজ্যিক কড়াকড়ির মাঝেই দ্রুত তাদের বয়ান ছড়াতে সাহায্য করে।

তামাক কোম্পানির ডিজিটাল মার্কেটিং সবসময় বিজ্ঞাপনের মতন দেখায় না। ট্রুথ ইনিশিয়েটিভের আরেকটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আমেরিকায় ১৫-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ১৫টি স্ট্রিমিং শো এর ৬০ শতাংশে তামাকের ব্যবহার দেখানো হয়েছে।  গবেষকেরা অনুমান করছেন এর ফলে প্রায় আড়াই কোটি তরুণ তামাক চিত্রাবলির অভিজ্ঞতা পেয়েছে। ২০২৩ সালের স্টপের একটি প্রতিবেদন “ফর্মুলা ১ঃ ড্রাইভ টু সাকসেস” নামক নেটফ্লিক্স সিরিজের চতুর্থ মৌসুমে তামাক কোম্পানির ব্র্যান্ডিং প্রদর্শনীর মাত্রা পর্যালোচনা করে দেখেছে, মোট প্রচারকালের ৩৩ শতাংশ সময়জুড়ে তামাক সংক্রান্ত চিত্রাবলি দেখানো হয়েছে। যখন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল ফর্মুলা ওয়ান টিমগুলোর পৃষ্ঠপোষক হয়, তখন এই প্রচারণা রেসট্র্যাকের সীমানা ছাড়িয়ে যায় এবং মানুষের ঘরের দুয়ারে পৌঁছে যায়।

অন্যান্য কোম্পানি সারোগেট মার্কেটিং এর আশ্রয় নেয় অনলাইনে, যেখানে তামাক পণ্যের ব্র্যান্ডিং (বা একই জাতীয় পণ্যের ব্র্যান্ডিং) ব্যবহার করা হয় অ-তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপনের কাজে। আরেকটি টার্ম রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সারোগেট মার্কেটিং এর ব্যাপকতা লক্ষ্য করা গেছে। এসব বিজ্ঞাপনের তিন চতুর্থাংশ ফেসবুক এবং ইন্সটাগ্রামে পরিবেশিত হয় মূলত এমন সব ব্র্যান্ডের জন্য যারা ধোঁয়াবিহীন তামাক বিক্রি করে।

বিদ্যমান নীতিমালা যদিও গণমাধ্যমে তামাক বিজ্ঞাপন, পণ্য প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতার মাত্রা কমাতে কাজে দিচ্ছে, ডিজিটাল মার্কেটিং একটি নতুন ক্ষেত্র এবং এ বিষয়ক উপযুক্ত নীতিমালা অদ্যবধি তৈরি হয়নি।

তামাক কোম্পানির ডিজিটাল বিজ্ঞাপন কেন ব্যতিক্রমভাবে হুমকিস্বরূপ

প্রথমত, ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের কোন সীমানা নেই। এক অঞ্চল বা দেশে নির্মিত কনটেন্ট বিজ্ঞাপনে নিষেধাজ্ঞা থাকা অন্যান্য অঞ্চলের দর্শকদের সাথে সহজে শেয়ার করা সম্ভব, যার ফলে জনসাধারণ  বিশেষ করে তরুণদের সুরক্ষা প্রদানকারী নীতিমালা ভঙ্গ করা সম্ভব হয়।

দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল মার্কেটিং আরও সর্বব্যাপী এবং ব্যক্তিগতকৃত। অনলাইন ব্যবহারকারীদের আচরণ কোম্পানিগুলোকে তাদের পণ্যে আগ্রহী হওয়ার সম্ভাবনা যাদের সবচেয়ে বেশি বলে ধারণা করা হয়,তাদের লক্ষ্যবস্তু বানাতে সহায়তা করে।

তৃতীয়ত, ডিজিটাল মার্কেটিং এর সহজগম্যতার কারণে- বিজ্ঞাপন সামনে আসে আবার চলে যায়, কনটেন্ট মুছে ফেলা যায়,পরিবর্তন করা যায় বা সবখানে ছড়িয়ে দেয়া যায়-তাই নজরদারি করা নিয়ন্ত্রকদের জন্য বেশ কঠিন। যখন বিজ্ঞাপনী কর্মকাণ্ড নজরে রাখা এবং নথিভুক্ত করা কঠিন হয়ে যায়, তখন নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও বিজ্ঞাপন দাতাদের দায়ী করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

চতুর্থত, তামাক কোম্পানির ডিজিটাল মার্কেটিং মূলত এর নতুনতর পণ্য,বিশেষ করে ই-সিগারেট এবং উত্তপ্ত তামাক সামগ্রীর প্রচারণা চালায়। যদিও এই প্রচারণাগুলোয় এসব পণ্যসমূহ সিগারেট হতে নিরাপদ হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে, সত্য হচ্ছে এগুলো নতুন ধরণের উচ্চ মাত্রার আসক্তকারী পণ্য যেগুলোর ভবিষ্যতকালীন স্বাস্থ্যঝুঁকি অজানা। বিশেষ করে উত্তপ্ত তামাক সামগ্রীর বিষয়টি বিতর্কিত, কেননা পিএমআইয়ের দাবীকৃত “ধোঁয়াবিহীন” হওয়ার বিষয়টির বিরুদ্ধ মত পাওয়া গেছে একটি স্বাধীন গবেষণা হতেএগুলো হয়ত আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি আসক্তকারী। সহজ ভাষায় বললে, এসব পণ্য সম্পর্কে অনেকটাই অজানা থাকলেও বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে সবার কাছে এগুলোর প্রচারণা চালানো হচ্ছে, যার মধ্যে আছে তরুণেরা।

প্রকৃতপক্ষে, তামাক কোম্পানির ডিজিটাল মার্কেটিং তরুণদের জন্য সবচেয়ে বেশি হুমকির। কোম্পানিগুলোর পণ্য তরুণদের আকর্ষণের লক্ষ্যে বিজ্ঞাপিত হচ্ছে এবং যেসব প্ল্যাটফর্ম তরুণেরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে, সেসকল স্থানে পরিবেশিত হচ্ছে।

তামাক কোম্পানির ডিজিটাল মার্কেটিং দ্রুত ছড়াচ্ছে ও রূপান্তরিত হচ্ছে। এর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে এবং কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনি কৌশল পূর্বানুমান করতে প্রয়োজন নতুন নীতিমালার, যেন তামাক শিল্পের আসক্তকারী ও বিপজ্জনক পণ্যের ছোবল থেকে পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করা যায়।