ফ্লেভারযুক্ত তামাক: তরুণদের নেশায় আসক্ত করার ৩টি পদ্ধতি
তামাক কোম্পানি জানে ফ্লেভারযুক্ত তামাক পণ্য অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং ব্যবহারে লাগাম টানা কষ্টকর।
বিশ্বব্যাপী, প্রায় প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ কিশোর-কিশোরী তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করে। আসুন, বিষয়টি খানিকটা সময় অনুধাবনের চেষ্টা করি।
তার মানে, কমপক্ষে ৩ কোটি ৮০ লাখ উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরী —যা সমগ্র কানাডার জনসংখ্যার সমান—দুটি কঠিন সমস্যার মুখোমুখিঃ তামাক ত্যাগ, অথবা এমন একটি পণ্যের নেশায় আজীবন আসক্ত হওয়া, যা তাদের বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত করবে, আর্থিক চাপে ফেলবে এবং শেষ পর্যন্ত অর্ধেক ব্যবহারকারীর প্রাণনাশের কারণ হবে। যে সমাজে তাদের বাস সেই সমাজও এই বেদনার ভাগীদার হবে। তামাক ব্যবহারের জন্য কেউ মারা গেলে বন্ধুবান্ধব ও পরিবারবর্গকে ভুগতে হবে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতি তামাক ব্যবহারজনিত অসুস্থতা ও অকালমৃত্যুর বোঝা বহন করবে।
এটা ভয়ানক। কিন্তু তামাক কোম্পানি পরবর্তী প্রজন্মকে নেশাগ্রস্ত করতে সফল হলে এ পরিণতি দেখা যায়। এখানে তিনটি পদ্ধতি বলা হয়েছে, তামাক পণ্যের ফ্লেভার কিশোরদের ধূমপান শুরু করা, নেশাগ্রস্ত হওয়া ও সবশেষে ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়।
1. ফ্লেভার অধিক আকর্ষণীয় মনে হয়
তরুণদের কাছে কম দাম থেকে শুরু করে সহজলভ্যতা,এমন যেসব বিষয় তামাককে আকর্ষণীয় করে তোলে, তন্মধ্যে ফ্লেভার বিশেষভাবে ক্ষতিকর। নবীন তামাক সেবকদের কাছে গলা ও ফুসফুস জ্বালাপোড়া করার পাশাপাশি চিরায়ত তামাকের স্বাদ ও ঘ্রাণ খুবই বাজে লাগতে পারে।
এ ব্যাপারে তামাক কোম্পানিগুলো অবগত আছে যে, এসবের ফলে তামাক সেবন আরম্ভ বাঁধাগ্রস্ত এবং ফলশ্রুতিতে তাদের মুনাফায় টান পড়তে পারে। তাই তামাক কোম্পানিগুলো তামাক প্রক্রিয়াজাত করার সময় বিভিন্ন ফ্লেভার, যেমন: ফল, মিস্টিদ্রব্য, মশলা ও মেন্থল যুক্ত করে। অতি সম্প্রতি, ২০০৭ সালে তামাক কোম্পানিগুলো ফ্লেভারযুক্ত ক্যাপসুল বাজারে আনে—সিগারেটের ফিল্টারে থাকা ছোট ক্যাপসুল তামাক সেবনের সময় ব্যবহারকারীরা চূর্ণ করে ফ্লেভার উন্মুক্ত করতে পারে, যা বাছাই ও মিথস্ক্রিয়ায় নতুন উপাদান যুক্ত করে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, তরুণ ব্যবহারকারীদের আসক্ত করতে তামাক কোম্পানিগুলোর ফ্লেভার ব্যবহারের প্রচেষ্টা কার্যকর। ২০২২ সালে একটি গবেষণা অনুযায়ী, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপের যুবক ও তরুণ জনগোষ্ঠীর ধূমপান শুরু করা এবং ধূমপান চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ফ্লেভারযুক্ত সিগারেট একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একই বিষয় উত্তর আমেরিকার পর্যবেক্ষণেও দেখা যায়। প্রায় ১৩,৬০০ জন মার্কিন কিশোর-কিশোরীর ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় উঠে আসে যে, সব ধরণের তামাকশ্রেণির মধ্যে, ফ্লেভারযুক্ত পণ্য ছিল তামাক ব্যবহারের সবচেয়ে প্রচলিত কারণ। এবং জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কখনও না কখনো তামাক সেবন করেছে এমন ৮৫ শতাংশের প্রথম সেবন করা তামাক দ্রব্য ছিল ফ্লেভারযুক্ত পণ্য। জাম্বিয়ার একটি জরিপে দেখা যায়, জরিপের ৬৯% তরুণ উত্তরদাতা মেন্থল পণ্য ব্যবহার করছে। এবং ফিলিপাইন-এর তরুণদের একটি দলীয় আলোচনায় মত দিতে দেখা যায় যে, ফ্লেভার ক্যাপসুলযুক্ত সিগারেটের প্যাকেট ফ্লেভারবিহীন ও সাধারণ মেন্থল সিগারেটের চাইতে অনেক বেশি আকর্ষণীয়, তাদের কেউ কেউ ক্যাপসুলের স্বাদকে মিস্টির (ক্যান্ডি) সঙ্গে তুলনা করে।
উল্টোটিও সত্য বলে প্রতীয়মান হয়: ফ্লেভারের ঘাটতি তামাকের আকর্ষন কমিয়ে দেয়। ব্রাজিল, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের বালিকা ও তরুণীদের ফ্লেভারযুক্ত তামাক সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে নিরীক্ষা চালানো চারটি গবেষণায় দেখা যায়, তামাকের মোড়ক হতে ফ্লেভারের বর্ণনা সরিয়ে নেয়ার ফলে এর আকর্ষণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।
2. ফ্লেভার কম ক্ষতিকর মনে করা হয়
তামাককে আরও আকর্ষণীয় মনে করানোর পাশাপাশি তামাকের মতো স্বাদ নয় এমন তামাককে কম ক্ষতিকর বলে হতে পারে।
ফ্লেভারযুক্ত তামাক বিষয়ে বালিকা ও যুবমহিলাদের ধারণা নিরীক্ষায় পরিচালিত চারটি গবেষণার মধ্যে দু’টি গবেষণায় দেখা যায়,অংশগ্রহণকারীরা মোড়কে ফ্লেভারের বর্ণনাযুক্ত পণ্যের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোড়কে ফ্লেভারের বর্ণনা নেই এমন পণ্যের তুলনায় কম বলে মত দিয়েছেনবিশেষ করে অল্পবয়সী মেয়েদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে ফ্লেভারযুক্ত তামাককে কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করতে দেখা গেছে।
কিশোর-তরুণেরাও এ ধরণের বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রে ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যের মোড়কীকরণ বিষয়ে ধারণাগত জরিপে দেখা যায়, প্রাপ্তবয়সীদের তুলনায় অল্পবয়সীরা এমনটা বেশি মত দেয় যে, মোড়কে ফ্লেভারের বর্ণনা নেই এমন দ্রব্যে ক্ষতিকর উপাদান বেশি থাকবে।
এমনকি ফ্লেভারযুক্ত তামাকের মধ্যেও, ভোক্তাদের কাছে কিছু ফ্লেভার অন্যান্য ফ্লেভারের চাইতে কম ক্ষতিকর বলে মনে হয়।
এমনকি ফ্লেভারযুক্ত তামাকের মধ্যেও, ভোক্তাদের কাছে কিছু ফ্লেভার অন্যান্য ফ্লেভারের চাইতে কম ক্ষতিকর বলে মনে হয়। এটা ধূমপানের সময় গলা ব্যাথা ও কাশির অভিজ্ঞতাকে চাপা দিতে পারে, এবং ধূমপানের ক্ষতি সম্পর্কে মিথ্যা ‘মানসিক স্বস্তি’ দেয়। এটা ফিলিপাইনের কিশোর-তরুণদের দলগত আলোচনায় দেখা যায়। অংশগ্রহণকারীরা অন্যান্য ফ্লেভারযুক্ত ও ফ্লেভারবিহীন সিগারেটের চাইতে মেন্থল-ফ্লেভারযুক্ত কয়েকটি সিগারেটকে কম ক্ষতিকর হিসাবে চিহ্নিত করে।
এমনকি যখন কোন একটি পণ্যে তামাকের উপস্থিতি ছিল না, তখনও তামাকের ফ্লেভারযুক্ত পণ্যের চাইতে তামাকের ফ্লেভারবিহীন পণ্যকে কম ক্ষতিকর বলে মনে হয়েছিল। যুক্তরাজ্যের কিশোরেরা ধারণা করে যে, তামাকের ফ্লেভারযুক্ত ই-সিগারেট, যাতে তামাক নাই, সেটা তামাকবিহীন ফ্লেভারযুক্ত ই-সিগারেটের চাইতে বেশি ক্ষতিকর,যেমন চেরি ও হাওয়াই মিঠাই। (পাদটীকা: বিশ্বব্যাপীও তরুণদের ই-সিগারেট ব্যবহারের প্রধাণ একটি কারণ হচ্ছে ফ্লেভার)।
3. ফ্লেভার নিয়মিত ব্যবহারের দিকে ধাবিত করে এবং ছাড়ার প্রচেষ্টা কঠিন করে তোলে
তরুণদের মধ্যে যারা ফ্লেভারবিহীন তামাক দ্রব্যের চাইতে অধিক আকর্ষণীয় বা কম ক্ষতিকর মনে হওয়ায় ফ্লেভারযুক্ত তামাক গ্রহণ করেন, তারা হয়ত নিয়মিত সেবনকারী হওয়ায় আগ্রহী হন না। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই আবার তা হয়ে ওঠেন।
কানাডায় ১৭,০০০ এরও বেশি তরুণদের মধ্যে পরিচালিত জরিপে দেখা যায় যে, যারা কোন না কোন সময় ফ্লেভারযুক্ত তামাক পণ্য ব্যবহার করেছিল তাদের সিগারেটে আসক্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এ ঝুঁকি ধোঁয়াবিহীন তামাকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্র হতে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় যে, ফ্লেভারমুক্ত ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার আরম্ভকারীদের মধ্যে ৪৮% একই তামাকের ব্যবহার অব্যাহত রাখে, অপরদিকে দিকে মিন্ট-ফ্লেভারযুক্ত পণ্য যারা ব্যবহার শুরু করেছিল তাদের ৬৪% ফ্লেভারযুক্ত পণ্য ব্যবহার অব্যাহত রাখে।
সিগারেটের বৈশ্বিক বাজারের ১০ শতাংশের মতন জুড়ে আছে মেন্থল ফ্লেভারযুক্ত তামাক, যা তামাকে দেয়া ফ্লেভারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত, এবং ছাড়ার ক্ষেত্রে বিশেষত কঠিন বলে প্রতীয়মান। যুক্তরাষ্ট্রে ধূমপায়ীদের মধ্যে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, মেন্থল ফ্লেভারের ধূমপায়ীরা ধূমপান ছাড়ার জন্য অনেক বেশি চেষ্টা করেছিল (মেন্থল সেবন না করা ধূমপায়ীদের চাইতে ৯% বেশি), তা সত্ত্বেও ধূমপান ত্যাগে তাদের সফলতা তুলনামূলক কম। পাঁচ বছরের সময়কাল বিবেচনায় মেন্থল ফ্লেভারের ধূমপায়ীদের ধূমপান ছাড়ার প্রবণতা ৬% কম। এটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য বিদ্যমান বৈষম্যের অবনতি ঘটায়, যাদেরকে তরুণদের পাশাপাশি মেন্থল বিপণনের মাধ্যমে তামাক কোম্পানি অবিরত উদ্দিষ্ট বানিয়ে চলেছে।
বৈশ্বিক তামাক মহামারীর জন্য ফ্লেভারযুক্ত তামাক একটি বড় কারণ – এবং ফ্লেভার নিষিদ্ধ করার এখনি সময়
যদি ফ্লেভারযুক্ত তামাক পণ্য, সম্পূরক ও আনুষাঙ্গিক উপাদান সর্বত্র নিষিদ্ধ হতো, তাহলে কল্পনা করুন সারা বিশ্বে কত কমসংখ্যক তরুণ তামাক ব্যবহার করত। কল্পনা করুন যদি কোন সরকার ফ্লেভার নিষিদ্ধ না করত তাহলে আরও কত বেশি সংখ্যক তরুণ তামাক ব্যবহারকারী হবে।
৩ কোটি ৮০ লাখ তরুণ শুধু পরিসংখ্যান নয়। এদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ে রয়েছে যাদের ভবিষ্যত তামাকজাত পণ্য এবং এসব পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর কারণে ধ্বংসের ঝুঁকিতে রয়েছে। যারা উন্নয়নশীল ও মধ্য আয়ের দেশে বসবাস করে, যেখানে পৃথিবীর ৮০% তামাক ব্যবহারকারী বসবাস করে, তাদের ঝুঁকি আরও বেশি।
তরুণদের তামাক গ্রহণ বৃদ্ধির প্রধান কারণ এবং বৈশ্বিক তামাক মহামারীর সংঘটক হিসেবে ফ্লেভারকে চিহ্নিত করার সময় এখন, যা প্রতিবছর বিশ্বে ৮০ লক্ষাধিক মানুষের অযাচিত মৃত্যুর কারণ। আরও বেশি তরুণ জনগোষ্ঠীকে তামাকের নেশায় ধাবিত হওয়া থেকে সুরক্ষার জন্য তামাক পণ্যে ফ্লেভারের ব্যবহার অবশ্যই নিষিদ্ধ করতে হবে।