আরও সংবাদ অনুসন্ধান করুন

ফ্লেভারযুক্ত তামাক: তরুণদের নেশায় আসক্ত করার ৩টি পদ্ধতি

তামাক কোম্পানি জানি ফ্লেভারযুক্ত তামাক পণ্য অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং ছেড়ে দেয়া কঠিন।

বিশ্বব্যাপী, ১৩-১৫ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করে। আসুন, এক মিনিটের মধ্যে বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করি।

তার মানে, কমপক্ষে ৩ কোটি ৮০ লাখ উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরী —যা সমগ্র কানাডার জনসংখ্যার সমান—দুটি কঠিন সমস্যার মুখোমুখি। তামাক ত্যাগ, অথবা এমন একটি পণ্যের নেশায় আজীবন আসক্ত হওয়া, যা তাদের বিকাশে বাধা দেয়, আর্থিক চাপ তৈরি করে এবং শেষ পর্যন্ত অর্ধেক ব্যবহারকারীর প্রাণ যাবে। নেশাগ্রস্ত কিশোরেরা যেখানে বসবাস করে সে সমাজও এতে কষ্ট অনুভব করে। তামাক ব্যবহারের জন্য কেউ মারা গেলে বন্ধুবান্ধব ও পরিবারবর্গকে ভুগতে হবে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতি তামাক ব্যবহারজনিত অসুস্থ্য ও অকালমৃত্যুর বোঝা বহন করবে।

এটা ভয়ানক। কিন্তু তামাক কোম্পানি পরবর্তী প্রজন্মকে নেশাগ্রস্ত করতে সফল হলে এ পরিণতি দেখা যায়। এখানে তিনটি পদ্ধতি বলা হয়েছে, তামাক পণ্যের ফ্লেভার কিশোরদের ধূমপান শুরু করা, নেশাগ্রস্ত হওয়া ও সবশেষে ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়।

1. ফ্লেভার অধিক আকর্ষণীয় মনে হয়

যেসব বিষয় তরুণদের মধ্যে তামাককে আকর্ষণীয় করে তোলে, তার মধ্যে রয়েছে স্বল্প দাম হতে সহজলভ্যতা, বিশেষ করে ফ্লেভারসমূহ খুবই বিপজ্জনক। নতুন ধূমপায়ীদের কাছে সাধারণ তামাকের স্বাদ ও গন্ধ খুবই খারাপ। এছাড়া গলা ও ফুসফুসে যন্ত্রণার কারণ।

তামাক কোম্পানিগুলো জানে যে, এটা ধূমপান শুরু করা থেকে শুরু করে তাদের মুনাফার পথে বাধা। তাই তামাক কোম্পানিগুলো তামাক প্রক্রিয়াজাত করার সময় বিভিন্ন ফ্লেভার, যেমন: ফল, মিস্টিদ্রব্য, মশলা ও মেন্থল যুক্ত করে। অতি সম্প্রতি, ২০০৭ সালে তামাক কোম্পানিগুলো ফ্লেভারযুক্ত ক্যাপসুল বাজারে আনে—সিগারেটের ফিল্টারে ছোট ক্যাপসুল ফ্লেভার দেয় যা ধূমপানের সময় ধূমপায়ীকে আকর্ষণ করে, পছন্দ করা এবং আন্তঃক্রিয়ার একটি উপাদান যুক্ত করে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, তরুণদের আসক্ত করতে তামাক কোম্পিানিগুলোর ফ্লেভার ব্যবহারের প্রচেষ্টা কার্যকর। ২০২২ সালে একটি গবেষণা পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপের তরুণ ও তরুণ জনগোষ্ঠীর ধূমপান শুরু করা এবং ধূমপান চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ফ্লেভারযুক্ত সিগারেট একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একই বিষয় উত্তর আমেরিকার পর্যবেক্ষণেও দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ১৩,৬০০ কিশোরের পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, সব ধরণের তামাকের মধ্যে তামাক ব্যবহারের সব সাধারণ কারণ হচ্ছে ফ্লেভার। এবং জরিপের ৮৫% যারা কখনও তামাক ব্যবহার করেছিল, তাদের প্রথম তামাক পণ্য ছিল একটি ফ্লেভারযুক্ত তামাক। জাম্বিয়ার একটি জরিপে দেখা যায়, জরিপের ৬৯% তরুণ উত্তরদাতা মেন্থল পণ্য ব্যবহার করছে। এবং ফিলিপাইন-এর একটি দলীয় আলোচনায় দেখা যায়, ফ্লেভার ক্যাপসুলযুক্ত সিগারেটের প্যাকেট ফ্লেভারবিহীন ও সাধারণ মেন্থল সিগারেটের চাইতে অনেক বেশি আকর্ষণীয়, তাদের কেউ কেউ ক্যাপসুলের স্বাদকে মিস্টির (ক্যান্ডি) সঙ্গে তুলনা করে।

বিপরীতও সত্য বলে প্রতীয়সান হচ্ছে: ফ্লেভারের ঘাটতি তামাকের আকর্ষন কমিয়ে দেয়। ব্রাজিল, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের মেয়ে ও তরুণীদের ফ্লেভারযুক্ত তামাকের বিষয়ে ধারণা সম্পর্কিত চারটি গবেষণায় দেখা যায়, ফ্লেভার সরিয়ে নিয়ে তামাকের প্যাকেট হতে আকর্ষণ অনেক কমে যায়।

2. ফ্লেভার মনে হয় কম ক্ষতিকর

এছাড়া তামাককে আকর্ষণীয় মনে করার পাশাপাশি তামাকের মতো স্বাদ নেই এমন তামাককে কম ক্ষতিকর বলে হতে পারে।

চারটি গবেষণার মধ্যে দু’টি গবেষণায় ফ্লেভারযুক্ত তামাক বিষয়ে বালিকা ও যুবমহিলাদের ধারণা পরীক্ষা করা হয়েছে, এতে অংশগ্রহণকারীগণ ফ্লেভারবিহীন প্যাকেটের চাইতে ফ্লেভারযুক্ত তামাককে কম ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত করেছেন, বিশেষ করে অল্পবয়সী মেয়েদের মধ্যে ফ্লেভারযুক্ত তামাককে কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করতে দেখা যায়।

কিশোর-তরুণদের মধ্যে এ বিষয়ে বিভ্রান্তি বেশি দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যের মোড়কীকরণ বিষয়ে ধারণাগত জরিপে দেখা যায়, প্রাপ্তবয়সীদের তুলনায় অল্পবয়সীরা জানায় যে, ফ্লেভারবিহীন প্যাকেটে বর্ণিত বিবরণের চাইতে বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক সরবরাহ করবে। 

এমনকি ফ্লেভারযুক্ত তামাকের মধ্যেও, ভোক্তাদের কাছে কিছু ফ্লেভার অন্যান্য ফ্লেভারের চাইতে কম ক্ষতিকর বলে মনে হয়।

এছাড়া ফ্লেভারযুক্ত তামাকের মধ্যেও, কিছু ফ্লেভার ভোক্তাদের কাছে কম ক্ষতিকর বলে মনে হয়। মিন্ট (পুদিনা) স্বাদ ছাড়াও, মেন্থল শীতল ও নিশ্চল ভাব প্রদান করে। এটা ধূমপানের সময় গলা ব্যাথা ও কাশির অভিজ্ঞতাকে চাপা দিতে পারে, এবং ধূমপানের ক্ষতি সম্পর্কে মিথ্যা ‘মানসিক স্বস্তি’ দেয়। এটা ফিলিপাইনের কিশোর-তরুণদের দলগত আলোচনায় দেখা যায়। অংশগ্রহণকারীরা অন্যান্য ফ্লেভারযুক্ত ও ফ্লেভারবিহীন সিগারেটের চাইতে মেন্থল-ফ্লেভারযুক্ত কয়েকটি সিগারেটকে কম ক্ষতিকর হিসাবে চিহ্নিত করে।

এমনকি যখন কোন একটি পণ্যে তামাক ছিল না, তখনও তামাকের ফ্লেভারযুক্ত পণ্যের চাইতে তামাকের ফ্লেভারবিহীন পণ্যকে কম ক্ষতিকর বলে মনে হয়েছিল। যুক্তরাজ্যের কিশোরেরা ধারণা করে যে, তামাকের ফ্লেভারযুক্ত ই-সিগারেট, যাতে তামাক নাই, সেটা তামাকবিহীন ফ্লেভারযুক্ত ই-সিগারেটের চাইতে বেশি ক্ষতিকর। (পাদটীকা: বিশ্বব্যাপী তরুণদের ই-সিগারেট ব্যবহারে মূল চালক হচ্ছে ফ্লেভার)।

3. ফ্লেভার নিয়মিত ব্যবহারের দিকে ধাবিত করে এবং ছাড়ার প্রচেষ্টা কঠিন করে তোলে

তরুণ জনগোষ্ঠী যারা তামাকে আসক্ত হতে চায় না তারা ফ্লেভারবিহীন তামাকের তুলনায় ফ্লেভারযুক্ত তামাককে খুবই আকর্ষণীয় ও কম ক্ষতিকর মনে করে। কিন্তু তাদের অনেকে তামাকে আসক্ত হয়ে পড়ে।

কানাডায় ১৭,০০০ তরুণদের মধ্যে পরিচালিত জরিপে দেখা যায় যে, যারা কোন না কোন সময় ফ্লেভারযুক্ত তামাক পণ্য ব্যবহার করেছিল তাদের সিগারেটে আসক্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এ ঝুঁকি ধোঁয়াবিহীন তামাকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যে দেখা যায় যে, যারা ফ্লেভারমুক্ত ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার শুরু করেছিলেন তাদের ৪৮% একই তামাকের ব্যবহার অব্যাহত রাখে, বিপরীত দিকে যারা মিন্ট-ফ্লেভারযুক্ত পণ্য ব্যবহার শুরু করেছিল তাদের ৬৪% একই ফ্লেভারযুক্ত পণ্য ব্যবহার অব্যাহত রাখে

মেন্থল হচ্ছে তামাক পণ্যে সবচাইতে বেশি ব্যবহৃত ফ্লেভার, বৈশ্বিক সিগারেটের ১০%-এ এটি ব্যবহৃত হয় এবং এটি ছেড়ে দেয়া কঠিন বলে প্রতীয়মান। যুক্তরাষ্ট্রে ধূমপায়ীদের মধ্যে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, মেন্থল ফ্লেভারের ধূমপায়ীরা ধূমপান ছাড়ার জন্য অনেক বেশি চেষ্টা করেছিল (মেন্থলবিহীন ধূমপায়ীদের চাইতে ৯% বেশি), কিন্তু ধূমপান ত্যাগে সফলতা কম। পাঁচ বছরের বেশি সময়ে মেন্থল ফ্লেভারের ধূমপায়ীদের ধূমপান ছাড়ার প্রবণতা ৬% কম। এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিদ্যমান বৈষম্য বাড়িয়ে তোলে, যুক্তরাষ্ট্রের কালো মানুষেরা এর মোকাবিলা করতে হয়।

বৈশ্বিক তামাক মহামারীর জন্য ফ্লেভারযুক্ত তামাক একটি বড় কারণ – এবং ফ্লেভার নিষিদ্ধ করার এখনি সময়

যদি ফ্লেভারযুক্ত তামাক পণ্য, যোগ করার বিভিন্ন উপাদান সর্বত্র নিষিদ্ধ হতো, তাহলে কল্পনা করুন সারা বিশ্বে কত কমসংখ্যক তরুণ তামাক ব্যবহার করত। কল্পনা করুন যদি কোন সরকার ফ্লেভার নিষিদ্ধ না করত তাহলে আরও কত বেশি সংখ্যক তরুণ তামাক ব্যবহারকারী হবে।

৩ কোটি ৮০ লাখ তরুণ শুধু পরিসংখ্যান নয়। এদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ে রয়েছে যাদের ভবিষ্যত তামাকজাত পণ্য এবং এসব পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর কারণে ধ্বংসের ঝুঁকিতে রয়েছে। যারা উন্নয়নশীল ও মধ্য আয়ের দেশে বসবাস করে, যেখানে পৃথিবীর ৮০% তামাক ব্যবহারকারী বসবাস করে, তাদের ঝুঁকি আরও বেশি।

তরুণদের তামাক গ্রহণের প্রধান কারণ ফ্লেভারকে চিহ্নিত করার সময় এসেছে এবং এটি বৈশ্বিক তামাক মহামারীর ষড়যন্ত্রকারী যা প্রতিবছর পৃথিবীতে অযথা ৮০ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর কারণ। আরও বেশি তরুণ জনগোষ্ঠীকে তামাকের নেশায় ধাবিত হওয়া থেকে সুরক্ষার জন্য তামাক পণ্যে ফ্লেভারের ব্যবহার অবশ্যই নিষিদ্ধ করতে হবে।